আশরাফুল আলম ►
বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি জাতির যে অন্বেষণ তা বহু দিনের আগের। এই সূত্রধরে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয় পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায়। এই বিক্ষোভ থেকে ক্ষোভের সঞ্চার হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বাংলা) বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য কওে রাজপথে নামে। আন্দোলনরত ছাত্রদেও মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে কিছু তাজা প্রাণ ঝড়ে পরে। তাদেও মধ্যে অন্যতম সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত এবং যথাযথ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গুরুত্বেও সাথেই পালন করা হয়। বাঙালিজ াতির অধিকার অর্জনের মাস ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের চেতনা উদ্ভাসিত হবার মাস এই ফেব্রুয়ারি। দিনের পর দিনভাষার গুরুত্ব এবং অর্জনের সংগ্রাম চিত্র বিশ্ব দরবাওে পরিচিত হতে থাকলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বওে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে অধিবেশনে ১৮৮টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায়‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এই মাতৃভাষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের কিছু অন্ধকার পরিস্থিতি বাঁধা হয়ে দাড়ায়। ১৯৪৭ আর ১৯৫২’র ইতিহাস পড়লেই অন্ধকার পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু বাঙ্গালী জাতি সেই অন্ধকারের বিনাশ ঘটিয়ে আলো জ্বালিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদার যাথাযথ স্বীকৃতি হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বিশ^ব্যাপী পালনের অনুমোদন অর্জন করেছে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে কিছু অর্জন অবশ্যই আমাদেরকে গর্বিত করে তার মধ্যে অন্যতম হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমরা ভুলতে পারিনা বাংলা ভাষার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই রবীন্দ্র নাথ তার লেখনীতে গোটা এশিয়ায় প্রথম নোবেল জয় করেছেন। তিনি গোটাবিশ্বে বাংলাভাষার পরিচিতি ঘটান। কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনীতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করে বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে অগ্নিঝংকার তুলে মানুষকে প্রতিবাদী করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। কিন্তু আলো আঁধারের খেলায় আমরা বারবার গুলিয়ে ফেলি। এই ভাষার ধারক বাহক বা উত্তরসুরী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা ভুলে যাই। এমন তো হবার কথা ছিলনা। তাজা প্রাণের বিনিময়ে যে ভাষাকে অর্জন করতে হয়েছে তার যথাযথ ব্যবহারের গাফিলতি মেনে নেয়া যায় না। দিনের এবং সংস্কৃতির পরির্তন হয়। কিন্তু ইতিহাস পরির্তন হতে পারে না। একুশে ফেব্রুয়ারির আগমনে আমরা পুরোনো ইতিহাস খুঁজে লালন করা চেতনাকে স্মৃতির পাতায় ঘষামাজা করে তুলে ধরার চেষ্টা করি। একুশের গান আমাদের শরীরের শিহরণ জাগ্রত করে। অনেকেরই জীবনে ছোট বেলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন শীতের শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে কলাগাছ অথবা বাঁশ আর রঙ্গিন কাগজে মোড়ানো শহীদ মিনার তৈরি করে সেখানে নিজেদের হাতের তৈরি ফুলের মালা নিয়ে বীর শহীদদের স্মরণ করা হতো। চোখ ছলছল আর শরীরের লোম শিউরে ওঠা সঙ্গীত ‘‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমিকি ভুলিতে পারি’’ মন থেকে হারিয়ে যায় না। আজ সেইদিনের আমেজ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিকতা আর পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সেই ঐতিহ্য। দোকানির ককশিটে তৈরি ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী কিনে নিয়ে ছবি তুলতে হুরোহুরি করে ব্যক্তি কিংবা দলীয় অথবা প্রতিষ্ঠানের আভিজাত্যকেই প্রকাশ করতে ব্যতিব্যস্ত।
পুরোনো ইতিহাসের কালো ঘনঘটা আর রাজপথে আন্দোলনের অর্জিত ফসল ঘওে তুলে তার যত্ন আমরা ভুলে যাই। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসে একুশের চেতনায় হাবুডুবু খাই। কিন্তু একুশ বা ফেব্রুয়ারি পার হলেই পরবর্তী মাসের দিনগুলোতে বাংলাভাষার শুদ্ধতা, উৎকর্ষতা, সুস্থতা, শহীদদের কথা, একুশের ত্যাগের কথা, শ্রদ্ধার কথা আর শুনতে পাওয়া যায় না। বলা যায়, কোন অস্তিত্ব না ভেবেই বাংলা ইংরেজির মিশ্রণ, বাংলার ভুল-ভাল উচ্চারণ, নিজের ইচ্ছে মতো উচ্চারণকে গুরুত্ব দিয়ে, মনের অজান্তেই মায়ের ভাষাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ভাষার আসল অস্তিত্বকে নষ্ট করে ফেলছি। কোথাও কোথাও ফেব্রুয়ারি মাসে কিংবা মাস পেরুলেই শহীদ মিনারে দাঁড়িয়েই হিন্দী গানের তালে নৃত্য করা, ইংরেজি গানের চর্চা অথবা সুর মিলিয়ে আনন্দ ফুর্তি কওে বাংলা ভাষাকেই যেন লজ্জিত করে ফেলি। সেদিক থেকে অবশ্যই আমরা বীর শহীদদেও আত্মত্যাগের মূল্য দিতে ব্যর্থ।
বীর শহীদদের প্রতি অবজ্ঞা করে সত্যিই কি একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া সম্ভব? ফেব্রুয়ারি আর একুশ আসলেই আমরা দেখি, সমাজের কিছু মানুষ একুশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনে ব্যস্ত সময় পার করেন। যার মুখে বাংলার উচ্চারণের ব্যঘাত ঘটে, বিদেশী ভাষার তামিল নিয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করে, যার বাড়িতে সন্তানরা উচ্চস্বওে ভিনদেশী গান, মাইকেল জ্যাকসন অথবা কোন রকস্টারের ভিন্ন ভাষার গান আর মিউজিকে নিজেদেরকে মাতিয়ে রাখেন, একুশ আসলে তারাই আবার বাজার ঘুওে সাদাকালো পাঞ্জাবি সংগ্রহ করে কাঁক ডাকা ভোরে মুখস্ত করা পাঁচজন ভাষা শহীদের নাম বলতে বলতে একুশের মহাকর্ম যোগ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখেন।সত্যিকারের দেশাত্ববোধের আড়ালে অভিনয়ের সুত্র বোঝা যায়। নাগরিকের এমন দ্বৈত চরিত্রে যেকোনো দেশপ্রেমিক মানুষের মনকে কষ্ট দেয়, আরতাতে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক।
অবাক লাগে এমন পরিবর্তনে। একুশ পার হলেই সব যেন ম্লান হয়ে যায়। তবে কি একুশ শুধুই একটি দিন, ফেব্রুয়ারি শুধুই একটি মাস ? মায়ের ভাষার এমন তাচ্ছিল্যকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাঙালির মনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির উৎপত্তি নিয়ে যে চেতনার জোয়ার দেখা যায় তা কোন ভাবেই একটি মাসের মধ্যে বেঁধে রাখা উচিৎ নয়। সারা বছর জুড়ে, সারাজীবন জুড়ে বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যেও মূল্যায়ন করতে হবে। একুশের চেতনা একদিনে জাগে না। এটি চর্চার মধ্য দিয়ে অনুভূতিকে জাগ্রত করতে হয়। সে চর্চায় যদি খাদ থাকে তবে সে চেতনা বধির হয়ে যাবে। নিয়মিত পাঠচক্র, পরীক্ষা, লেখা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই চেতনা শাণিত হবে। চেতনারশাণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মেও দিকে ধাবিত হবে। অন্যথায় একুশকে দিনের এবং মাসের উৎসবে সীমাবদ্ধ রাখলে ভাষার উপর যে আত্বঘাতী আঘাত আসবে তা থেকে বাংলাভাষাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। ভাষা শহীদদেও প্রতি আমাদের ভালোবাসা যেন লোক দেখানো না হয়। তাদের আত্মার প্রতিশ্রদ্ধা যেন শুধু শরীরিক ভঙ্গিতে না হয়। এটি যেন প্রকাশ পায় প্রাণের স্পন্দনে। সেই প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মাঝে এই চেতনাকে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি যথাযথ ব্যবস্থা হিসেবে সকল শিক্ষার্থীর মাঝে বিতর্ক, বানানের চর্চা, গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখালেখির আয়োজন করতে হবে। এছাড়াও দেশের আগামী প্রজম্মেও উত্তরসুরীদেও মাতৃভাষার সংস্কৃতি ও সংগ্রামী ইতিহাস পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাবধান তার কথা একুশের মধ্যে যে বাঙালি জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে সেই আবেগকে প্রচন্ড শক্তি হিসেবে আমাদের দেখা উচিৎ। আমাদেও অস্তিত্বে, ভাষা ও সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসে যে চেতনা গাঢ় রক্ত হয়ে হৃদয়ে মিশে আছে তাকে ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না। একুশের মিছিল, একুশের শ্লোগান, একুশের হৃদয় স্পর্শীগানকে লালন কওে সার্বজনীন চর্চা করতে হবে। শুরুতে আঁধার থেকে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাভাষার মর্যাদা আজ যে আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আলোক বর্তিকা ছাড়াচ্ছে তা যেন আমাদেও বিরূপ আচরণে আবার আঁধারে হারিয়ে না যায়। এই প্রতিজ্ঞাই হোক বাংলাভাষা প্রিয় সকল উত্তরসূরী বাঙালির চেতনা।
লেখক- উন্নয়ন কর্মী।